চতুর্থ দিনেও শুরু হয়নি রূপগঞ্জের গাজী টায়ারসে ক্ষতিগ্রস্থ ৬তলা ভবনে উদ্ধার অভিযান। মঙ্গলবার অভিযান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ভবনটির অবস্থা ‘অনিরাপদ’ থাকায় কাজ শুরু করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। কবে শুরু করবে সেটাও নিশ্চিতভাবে বলতে পারেছে না তারা।
আজ বেলা ৩টায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে জেলা প্রশাসনের ৮সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটিতে জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস, জেলা পুলিশ, উপজেলা প্রশাসন, কলকারখানা অধিদপ্তর, গণপূর্ত বিভাগ, তিতাস, পল্লী বিদ্যুতের প্রতিনিধিরা ছিলেন৷ এ সময় তারা কারখানা কর্তৃপক্ষ, প্রত্যক্ষদর্শী, নিখোঁজদের স্বজনদের সাথে কথা বলেন৷
পরিদর্শন শেষে তারা জানায়, উদ্ধার অভিযানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে আগামাকীল (বৃহস্পতিবার)৷ স্থানীয় জনবলের মাধ্যমে উদ্ধার অভিযান চালানোয় সক্ষম না হলে জাতীয়ভাবে অভিজ্ঞদের সহযোগিতা চাওয়া হবে, প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর এক্সপার্ট টিমকেও ব্যবহার করা হবে।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমান বলেন, লোকালি যারা এক্সপার্ট আছে তারা যদি ব্যর্থ হন, তাদের ইকুপমেন্টগুলো দিয়ে যদি উদ্ধারকাজ চালাতে সক্ষম না হয় তাহলে ন্যাশনালি সাপোর্ট আমরা নেবো৷ প্রয়োজনে স্বাস্থ্য বিভাগের অভিজ্ঞদের সহযোগিতাও নেয়া হবে৷
তিনি আরও বলেন, ফায়ার সার্ভিসের ড্রোন, বড় মই দিয়ে ভবনের ভেতরে প্রাথমিকভাবে তারা সার্চ করে দেখেছেন কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা কোনো ডেড বডি পাননি৷ তারপরও আমরা মনে করছি, এখানে যেহেতু অনেক বেশি কেমিক্যাল পুড়েছে, সুতরাং কোনো মানুষ যদি আদৌ থেকে থাকে তাহলে সেই মৃতদেহ পাবার সম্ভবনা তেমন নেই৷ কেননা ২১-২২ ঘন্টা টানা আগুন জ্বলেছে৷ আপনারা বুঝতে পারছেন তিন-চার ঘন্টার মধ্যেই একটা মানুষ মরদেহ কয়লা হয়ে যাবার কথা৷
নিখোঁজদের ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তালিকা করা হয়েছে জানালেও কতজন তালিকাভুক্ত হয়েছেন সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা জানাননি তিনি৷
হামিদুর বলেন, যে ব্যক্তি এসে বলছেন যে তার স্বজন নিখোঁজ আছেন তাদের নাম-ঠিকানা আমরা লিপিবদ্ধ করছি৷ আমরা নির্দিষ্ট বলতে পারছি না৷ তবে আগুনের সময় ভবনটিতে শতাধিক ব্যক্তি ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন৷ যদিও নির্দিষ্ট কোনো প্রুফ আমরা পাইনি৷ কিন্তু এখানে একজন মানুষ থেকে থাকলেও সেটি গুরুত্ব সহকারে নেবো৷ আমাদের মূল চেষ্টাটা হলো ভেতরের অবস্থাটা কী তা দেখা৷’
জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ছাইফুল ইসলাম বলেন, মঙ্গলবারও ভবনটিতে আগুন জ্বলতে থাকায় তারা ভেতরে ঢুকে কাজ করতে পারেননি৷ বুধবার আগুন নেভানো গেলেও ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে৷ এ ব্যাপারে আমরা সিদ্ধান্ত দিতে পারছি না৷ বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দল আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) আসবে৷ তারা সিদ্ধান্ত দেবেন৷
এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটিতে থেমে থেমে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার সকাল পাঁচটার দিকে ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর কথা জানালেও বিকেলের পর আবারও ভবনটিতে আগুন জ্বলে ওঠে৷ সন্ধ্যার পর রাতে আগুনের তীব্রতা বাড়ে৷
আজ বুধবার সকালে নারায়ণগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের (জোন-২) উপসহকারী পরিচালক আব্দুল মন্নান জানান, মঙ্গলবার রাতের মধ্যেই আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছে। তবে ভবনটি উত্তাপ থাকায় পানি ছিটিনো হচ্ছে।
বুধবার দিনভর আগুন তেমনভাবে লক্ষ্য করা যায়নি। তবে সন্ধ্যায় ফের ভবনটিতে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
গত ২৫ আগস্ট কারখানাটির মালিক সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গ্রেপ্তারের খবর ছড়িয়ে পরেলে তার নির্বাচনী এলাকা রূপগঞ্জে। এর পরপরই গত রোববার দুপুরে টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানাটির অদূরে একটি মসজিদ থেকে মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক জড়ো করেন একদল ব্যক্তি৷ অভিযোগ রয়েছে, কারখানাটি তৈরির ক্ষেত্রে অবৈধভাবে স্থানীয়দের জমি দখল করা হয়েছিল। সেই ক্ষোভ থেকে মাইকের ঘোষণার পর কয়েকশ লোক জড়ো হন কারখানাটির সামনে।
জানা যায়, রোববার বিকেল ৩টা থেকে শুরু হয় লুটপাট৷ লুটপাটকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। যার এক পর্যায়ে রাত ৯টার দিকে কারখানাটির ভেতরের একটি ছয়তলা ভবনে আগুন দেয় লুটপাটকারীদের একটি অংশ৷
ওই ঘটনা স্বজন নিখোঁজের দাবি জানিয়ে রোববার থেকে কারখানার সামনে অপেক্ষারত মানুষের ভীর। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃক করা এক তালিকা অনুযায়ী, এ ঘটনা ১৭৫ জন নিখোঁজ রয়েছে।
রোববার রাতের ঘটনার পর থেকে বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নিখোঁজদের স্বজনরা ভিড় করছেন কারখানার গেটে৷ উদ্ধার অভিযান শুরুতে দেরি করায় ক্ষোভ ঝেরেছেন কেউ কেউ৷
গত ২৫ আগস্ট রাতে কারখানাটিতে আগুন দেয়ার আধ ঘন্টা আগে বন্ধুদের সাথে কারখানাটিতে আসে মনির হোসেন নামে এক যুবক। ভবনের তৃতীয় তলায় ছিলেন তারা। বন্ধুরা বেরিয়ে আসলেও সেখানে আটকা পরে মনির।
গত তিনদিন ছোট ভাই মনিরের ছবি হাতে ঘটনাস্থলে অবস্থান করছেন বড় ভাই জাকির হোসেন। খোঁজ পেতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার বেশ কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ করেছেন। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাননি মনিরকে।
জাকির হোসেন বলেন, আমি জানি ভাইকে আর ফিরে পাবো না। কিন্তু ওর অবশিষ্ট টুকু নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই। বাবা-মাকে দিতে চাই।