সেন্ট জর্জেস থেকে রাওয়ালপিন্ডি- ঐতিহাসিক সাফল্যগাথা রচনার জন্য বাংলাদেশ দলকে ১৫ বছরে পরিভ্রমণ করতে হয়েছে অনেক শহর। ২০২২ সালের একেবারে শুরুতে মাউন্ট মঙ্গানুইয়ে জেতার পর ক্রাইস্টচার্চে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। মাঝে আরও অনেক শহর, নগর ঘুরেও কাক্সিক্ষত সাফল্য ধরা দেয়নি। সে কারণে দেশের বাইরে সিরিজ জয়ের চিন্তাটাও অলিক কল্পনা হয়ে যায়।
পিন্ডিতে অবিশ্বাস্য ব্যাপারটাই বাস্তব করেছে বাংলাদেশ। স্বাগতিক পাকিস্তানকে সিরিজের দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে ৬ উইকেটে হারিয়ে ২-০ ব্যবধানে তাদের হোয়াইটওয়াশ করেছে। আগের দিন ১৭২ রানে পাকিস্তান গুটিয়ে গেলে জয়ের জন্য বাংলাদেশের টার্গেট দাঁড়ায় ১৮৫ রান। মঙ্গলবার ৪ উইকেট হারিয়ে লক্ষ্যে পৌঁছে টাইগাররা।
বাংলাদেশের এটি মাত্র তৃতীয়বার বিদেশের মাটিতে সিরিজ জয় যার মধ্যে প্রতিপক্ষকে ধবলধোলাইয়ের ঘটনা দুটি। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে যাবে পাকিস্তানের বিপক্ষে এই অর্জন। কারণ আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে তাদের হোয়াইটওয়াশ করেছে টাইগাররা এবং ঘরের মাটিতে শুধু ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের কাছে হোয়াইটওয়াশ হয় পাকরা। তাই প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেই অভিনন্দন জানিয়েছেন দলের ক্রিকেটারদের।
প্রথম টেস্টে ১০ উইকেটের বড় জয় পায় বাংলাদেশ। তবে কৃতিত্বটা সেভাবে বাংলাদেশ দলকে দিতে চায়নি প্রতিপক্ষরা। কারণ উইকেটের আচরণ হঠাৎ করেই বিরূপ হয়েছে যা সফরকারীদের জন্য সহায়ক হয়ে ওঠে বলে দাবি তাদের। এ যেন ‘নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা’ অবস্থা। তবে প্রতিপক্ষ যাই বলুক বাংলাদেশ দল সেই জয়ের পর উজ্জীবিত হয়েছে এবং আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছে দারুণ কিছু করার।
সেই অনুপ্রেরণা নিয়ে অবশ্য একই ভেন্যুতে নেমে দ্বিতীয় টেস্টে ব্যাকফুটে থাকে বাংলাদেশ দলই। কারণ তুলনামূলক কঠিনতর উইকেটে পাকিস্তানের প্রথম ইনিংস ২৭৪ রানে গুটিয়ে দিতে পারলেও নিজেরা থেমে যায় ২৬২ রানে।
বোলাররাই পিন্ডিতে হয়ে ওঠেন মূল চালিকাশক্তি। ১২ রানে পিছিয়ে থাকার পর তাই বোলারদের ওপরই নির্ভর করেছে বাংলাদেশ দল। সেখানেও বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় যে নিয়মিত পারফর্মার বাঁহাতি পেসার শরিফুল ইসলাম ইনজুরিতে ছিটকে গেছেন। ১৪ মাস পর ফিরে আসা তাসকিন আহমেদকে নিয়ে তেমন আশান্বিত হওয়া যায়নি। কারণ এই লম্বা সময় তিনি লঙ্গার ভার্সন খেলেননি।
এ ছাড়া মাত্র ২ টেস্ট খেলার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দুই পেসার হাসান মাহমুদ ও নাহিদ রানা আছেন। বাঁহাতি স্পিনার সাকিব আল হাসান তেমন ফর্মে নেই। এরপরও দুর্দান্ত বোলিং করেন পেসরারা। পাক পেসারদের দাপটে বাংলাদেশী ব্যাটাররা নাজেহাল হয়েছেন, তেমনি বাংলাদেশী পেসাররাও বিপর্যস্ত করেন পাক ব্যাটারদের। ১৭২ রানেই দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে যায় পাকরা।
১৮৫ রানের জয়ের লক্ষ্য নিয়ে নেমে বাংলাদেশ চতুর্থ দিন মাত্র ৭ ওভার ব্যাটিংয়ের সুযোগ পেয়েছে। ৪২ রান তুলে ফেলে দ্রুতগতিতে বিনা উইকেটে। তবে আলোর স্বল্পতার জন্য প্রায় দেড় ঘণ্টা আগেই চতুর্থ দিনের খেলায় সমাপ্তি টানা হয়। পঞ্চম দিন জিততে আরও ১৪৩ রানের প্রয়োজন বাংলাদেশের। হাতে ১০ উইকেট থাকলেও নানা শঙ্কার ঘনঘটা।
কারণ এবার পিন্ডির উইকেট যত কঠিন ব্যাটারদের জন্য তা স্বাভাবিকভাবেই পঞ্চম দিন অগ্নিপরীক্ষার মঞ্চ হয়ে যাবে। প্রথম ইনিংসেই যেখানে চতুর্থ দিন সকালে বাংলাদেশ মাত্র ৫৭ বলে ১৬ রান তুলতেই ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলে বাংলাদেশ, পঞ্চম দিন না জানি কি হয়! এর সঙ্গে বৃষ্টি-ঝড়ের পূর্বাভাস থাকায় খেলা মাঠে গড়ানো নিয়ে সংশয়! এসব পাশ কাটিয়ে অবশ্য পঞ্চম দিন বেরোতে পারেনি বাংলাদেশের ব্যাটাররা। প্রথম থেকেই পাক পেসারদের বলে বড় বিপদের আঁচ পাওয়া গেছে।
তারা যেমন তেজোদীপ্ত ছিলেন, তেমনি বলের গতি-প্রকৃতিও সহজ ছিল না। আগের দিন জাকির হাসান টি২০ মেজাজে ব্যাট চালিয়ে ২৩ বলে ৩১ রানে অপরাজিত থাকেন। তবে পঞ্চম দিন সকালে তাকে সেই ছন্দে দেখা যায়নি। শেষ পর্যন্ত ৩৯ বলে ৩ চার, ২ ছক্কায় ৪০ রানে বিদায় নেন জাকির। ৫৮ রানের উদ্বোধনী জুটি ভেঙে যায়। পেসার মির হামজার দুর্দান্ত ডেলিভারিতে জাকির বোল্ড হয়েছেন। গত দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশের ওপেনিং জুটিতে এটাই প্রথম পঞ্চাশোর্ধ্ব রান। সাদমান ইসলামও তেমন স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন না।
১৭ রানে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যান হামজার বলে। কিন্তু ২৪ রানে বিদায় নেন খুররম শাহজাদকে তুলে মারতে গিয়ে। ফলে ৭০ রানে ২ উইকেট হারিয়ে কিছুটা চাপেই পড়ে বাংলাদেশ। কিন্তু অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত নিজের সেরা খেলাটা উপহার দিয়েছেন এদিন দীর্ঘ সময় পর।
তৃতীয় উইকেটে শান্ত আর মুমিনুল হক ৫৭ রানের জুটি গড়ে আউট হন শান্ত। ৮২ বলে ৫ চারে ৩৮ রানে বিদায় নেন তিনি।
তখনো জয় থেকে ৫৮ রান দূরে বাংলাদেশ। এরপর দুই অভিজ্ঞ মুমিনুল ও মুশফিকুর রহিম ২৬ রানের জুটি গড়ে জয়ের পথে নিয়ে গেছেন বাংলাদেশকে। কয়েকবার এলোমেলো শট খেলে বেঁচে যাওয়া মুমিনুল ৭১ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ৩৪ রান করে লেগস্পিনার আবরার আহমেদের শিকার হন। এরপরে আর পাক বোলারদের সুযোগ দেননি মুশফিক ও সাকিব আল হাসান। দলকে জিতিয়েই মাঠ ছেড়েছেন তারা। মুশফিক ২২ ও সাকিব ২১ রানে অপরাজিত থাকেন।
প্রথম ইনিংসে ২৬ রানে ৬ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ এটাই এখন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে সবার কাছে। রূপকথার মতোই ঘটেছে ঘটনাটি। এত কম রানে ৬ উইকেট হারিয়েও জয় টেস্ট ক্রিকেটে দেখা গেল ১৩৭ বছর পর! সেই ১৮৮৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ও পরে ৪৫ রানে অলআউট হয়েও শেষ পর্যন্ত ১৩ রানে ম্যাচ জিতেছিল ইংল্যান্ড। এবার বাংলাদেশও এই রেকর্ডে তাদের সঙ্গী।
এ নিয়ে মাত্র দ্বিতীয়বার ঘরের মাটিতে টেস্ট সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হয়েছে পাকরা। ২০২২ সালে ইংল্যান্ডের কাছে ৩-০ ব্যবধানে নিজেদের মাঠে হোয়াইটওয়াশ হয় তারা। এর আগে বিশে^র সেরা দলগুলোর মধ্যে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ২ বার (২০২২ ও ২০২৩) ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একবার (২০১৭) সুযোগটা পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি টাইগাররা। এবার পেরেছে এবং নবম সিরিজ জয় করেছে।
তবে দেশের বাইরে মাত্র তৃতীয় সিরিজ জয় এটি। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ২০২১ সালে জিম্বাবুয়ে সফরে সিরিজ জিতেছিল বাংলাদেশ। আইসিসি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে এই প্রথম সিরিজ জিতেছে বাংলাদেশ। আগের দুই টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম চক্রে ১ ড্র এবং দ্বিতীয় চক্রে ১ ড্র ও ১ জয় পেয়েছিল। এবার সবমিলিয়ে জিতল ৩ ম্যাচ এবং একটি সিরিজ জয়ও ধরা দিয়েছে।
এমন অবিস্মরণীয় কীর্তির পর গত দুই মাসে নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশকে স্বস্তির হাসি উপহার দিয়েছেন টাইগাররা। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চলতি চক্রে এখন ৪ নম্বর অবস্থানে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ৬ টেস্টে ৩ জয়, ৩ হারে ৩৩ পয়েন্ট এবং পয়েন্টের হার ৪৫.৮৩!
ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন ড. ইউনূসের :
পাকিস্তান ক্রিকেট দলকে ধবলধোলাই করে তাদের মাটিতে প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে তিনি ক্রিকেট দলের অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্তকে ফোন করে ঐতিহাসিক বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানান। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো বার্তায় এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
ড. ইউনূস শান্তকে বলেন, ‘সরকার ও আমার পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশ দল দেশে ফেরার পর সংবর্ধনার কথাও বলেন তিনি।’
পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত দুই ম্যাচ টেস্ট সিরিজের দুটোতেই দাপুটে ও গৌরবময় জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। টেস্ট স্ট্যাটাস অর্জনের ২৪ বছর পর পাকিস্তানের মাটিতে পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট ম্যাচ এবং সিরিজ জয়ের স্বাদ পেলো টিম-টাইগার্স।