Homeআইন অপরাধসারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু যৌথবাহিনীর ; সন্তোষজনক পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত চলবে...

সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু যৌথবাহিনীর ; সন্তোষজনক পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত চলবে এ অভিযান

রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে শুরু হয়েছে যৌথবাহিনীর অপারেশন। মঙ্গলবার রাত ১২টায় একযোগে মাঠে নামেন এ বাহিনীর সদস্যরা। অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও মাদকের গডফাদারদের ধরাই তাদের টার্গেট। এবারের অভিযানে মূলত থানা-ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারকেই প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তা ছাড়া দাগি অপরাধী ও ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। মাঠের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত চলবে এ অভিযান।
তবে সারাদেশের থানাগুলো থেকে কত অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট হয়েছে, সে পরিসংখ্যান সোমবার পর্যন্ত জানাতে পারেনি পুলিশ সদর দপ্তর। যদিও মিডিয়া বিভাগ জানিয়েছে, মঙ্গলবারের পর জানানো হবে। আর ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের তিন হাজার ৮৮০টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
সর্বশেষ জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে তিনদিন রাজধানীসহ দেশজুড়ে প্রায় পাঁচশ’ থানায় হামলা হয়। লুটপাট করা হয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা ও পুলিশের যানবাহন।
এসব ঘটনায় পুলিশের প্রায় সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। অগাস্টের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সব থানার কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো পুরোদমে পুলিশের সেই তৎপরতা আগের মতো চোখে পড়েনি। এমন বাস্তবিক পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার রাতে শুরু হয় যৌথ বাহিনীর অপারেশন।
জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ নেয়।
বিশেষ করে আন্দোলনের সময় থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র ও গুলি পুরোপুরি উদ্ধার হয়নি। সেগুলো দুর্বৃত্তদের হাতে রয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দেওয়া অস্ত্রের লাইসেন্সও স্থগিত করে সেগুলো থানায় জমা দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময় বেঁধে দিলেও তাতে কাক্সিক্ষত ফল মেলেনি।

এখনো জমা পড়েনি অনেক অস্ত্র। শুধু রাজধানী ঢাকা থেকেই এক হাজার ৮৯৮টি অস্ত্র লুট হলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত তার এক-তৃতীয়াংশ জমা পড়েছে। এখনো রয়ে গেছে বিপুলসংখ্যক অবৈধ অস্ত্র, যা উদ্ধারের জন্যই মঙ্গলবার রাতে মাঠে নামে যৌথবাহিনী।
এদিকে রবিবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানের পাশাপাশি মাদক চোরাচালানের সঙ্গে সম্পৃক্ত গডফাদারদের ধরা হবে।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আজকের সভাটি ছিল আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভা। এ সভায় প্রধানত দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কথা হয়েছে। কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করা যায়, সেসব নিয়ে কথা হয়েছে। এ বিষয়ে আমরা কিছু পদক্ষেপ নেব। মঙ্গলবার সব বৈধ এবং অবৈধ অস্ত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন। রাত ১২টা থেকে আমাদের যৌথবাহিনীর অপারেশন শুরু হবে অস্ত্র সংগ্রহের জন্য।

উপদেষ্টা বলেন, মাদক আমাদের বড় সমস্যা। আমরা কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি সে বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আমাদের জন্য খুবই জরুরি। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছি। মাদকের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছি।
তিনি বলেন, আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পূজা যেন ঠিকভাবে হতে পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমরা আশা করছি, পূজাটা খুব ভালোভাবে শেষ হবে। কোথাও কোনো সমস্যা হবে না। মিয়ানমারের সীমান্ত নিয়ে যে সমস্যা সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা কী কী পদক্ষেপ নিচ্ছি, সেটা অনগ্রাউন্ড দেখতে পাবেন।
জানা গেছে, বর্তমানে স্থগিত করা লাইসেন্সের বিপরীতে থাকা অস্ত্র ও গোলাবারুদ থানায় জমা না দিলেও উদ্ধার অভিযানে সেগুলো জব্দ করা হবে। একইসঙ্গে পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেহাত হওয়া এবং হারানো অস্ত্রসহ যে কোনো অবৈধ অস্ত্র এ অভিযানে উদ্ধার করা হবে। সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, র‌্যাব ও আনসারের যৌথ সমন্বয়ে অপারেশন টিম গঠন করে অভিযান চালানো হচ্ছে। মহানগর এলাকায় অভিযান চালাচ্ছেন পুলিশ কমিশনার।

সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় এ অভিযান চালানো হচ্ছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে কোর কমিটির মাধ্যমে স্থগিত করা লাইসেন্সের তালিকা পর্যালোচনার ভিত্তিতে অভিযান পরিচালিত হবে। এই কমিটিতে পুলিশ সুপার, সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধি এবং অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র সংরক্ষণ বা হেফাজতকারীদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা দায়েরসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি জেলা তথ্য অফিস প্রচার করবে। এ সংক্রান্ত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, তিন তারিখের পরে কিন্তু সেগুলো অবৈধ অস্ত্র হিসেবে গণ্য হবে। অস্ত্র আইনে কিন্তু মামলা রুজু হবে।
উল্লেখ্য, গত জুলাই মাসে ছাত্র-আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। দুর্বৃত্তদের হামলায় ৪৪ জন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন। তাদের হত্যা ও থানা-ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে বেশিরভাগ আগ্নেয়াস্ত্র লুট করে নিয়ে গেছে। সে সময় দেখা গেছে, কিছু এলাকায় তৎকালীন শাসক দল আওয়ামী লীগের লোকজনও বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করেছে।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ বছরে এক লাখের বেশি অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়। তবে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ইতোমধ্যে সব ধরনের অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। থানা থেকেও প্রচুর অস্ত্র লুট করা হয়েছে। অর্ধেকেরও কম অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
এদিকে বর্তমানে দেশে কী পরিমাণ বৈধ ও অবৈধ অস্ত্র রয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নিয়েও ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। বর্তমানে সারাদেশে বৈধ অস্ত্রের সংখ্যা ৫০ হাজার ৩১০। এর মধ্যে ব্যক্তিগত অস্ত্র ৪৫ হাজার ২২৬টি।

এগুলোর মধ্যে পিস্তল চার হাজার ৬৮৩টি, রিভলবার দুই হাজার ৪৩টি, একনলা বন্দুক ২০ হাজার ৮০৯টি, দোনলা বন্দুক ১০ হাজার ৭১৯টি, শটগান পাঁচ হাজার ৪৪৪টি, রাইফেল এক হাজার ৭০৬টি এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে চার হাজার ছয়টি। বাকি অস্ত্রগুলো বিভিন্ন আর্থিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স করা।
প্রাপ্ত হিসাব বলছে, এসব অস্ত্রের মধ্যে ১০ হাজার ২১৫টি রয়েছে রাজনীতিবিদদের কাছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে রয়েছে সাত হাজার ২১৫টি আগ্নেয়াস্ত্র। বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে দুই হাজার ৫৮৭টি এবং অন্যান্য দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের নামে ৭৯টি বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।
জানা গেছে, গত সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন সময় বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। ওই সময় থানা ছাড়াও লাইসেন্সধারী বন্দুক ব্যবসায়ীরা বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়া ও সংরক্ষণ করতে পারতেন। কিন্তু এবারই প্রথম প্রজ্ঞাপনে সে ধরনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ আর্মস ডিলার অ্যান্ড ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন থেকেও ক্ষোভ জানানো হয় এবং তাদের একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এ অবস্থায় গত সপ্তাহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ এক ঘোষণায় ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বেসামরিক জনগণকে দেওয়া সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত করে। একই সঙ্গে ৩ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব বৈধ লাইসেন্স গ্রহীতার স্থায়ী ঠিকানার থানায় অথবা বর্তমান বসবাসের ঠিকানার থানায় নিজে বা মনোনীত প্রতিনিধির মাধ্যমে জমা দিতে বলা হয়।

যদিও ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে-যাদের আগ্নেয়াস্ত্র থানা, জেলা ট্রেজারি ও আর্মস ডিলারদের কাছে জমা রাখা আছে, তাদের ক্ষেত্রে অস্ত্র জমাদানের বিষয়টি প্রযোজ্য হবে না। এ ছাড়া আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স স্থগিত ও জমা দেওয়ার নির্দেশের পর অনেকেই সংশ্লিষ্ট থানায় যোগাযোগ করছেন। কীভাবে অস্ত্র জমা দেবেন, সে বিষয়ে জানতে চাইছেন। অনেক থানার নথিপুড়ে যাওয়ায় অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজধানীর মিরপুর মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, অগ্নিসংযোগের কারণে আমাদের থানাভবন সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। এজন্য মিরপুর এলাকার বৈধ অস্ত্র ব্যবহারকারীদের কাফরুল থানায় অস্ত্র জমা দেওয়ার জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়। এ ছাড়া থানার নথি পুড়ে যাওয়ায় মিরপুর থানা এলাকায় লাইসেন্সপ্রাপ্তদের তথ্য আমাদের কাছে নেই। এই তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।

যে কোনো সময়ে থানায় সাধারণ ডায়েরি করে অস্ত্র জমা দেওয়া যাবে বলে বৈধ অস্ত্র গ্রহীতাদের জানানো হয়েছে। একইভাবে ভাটারা থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, আমার থানা আক্রান্ত হওয়ায় অনেক নথি ধ্বংস হয়ে গেছে। অস্ত্র জমা দিতে অনেকে যোগাযোগ করেছেন। আমরা শুরুতে নিতে পারেনি।
এ বিষয়ে

ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের। ওই সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন থানা থেকে এক হাজার ৮৯৮টি আগ্নেয়াস্ত্র লুট হয়েছে। খোয়া যাওয়া বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের মধ্যে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এর অর্ধেকও উদ্ধার বা জমা হয়নি।

পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ৩৪৮টি চায়না রাইফেল, শটগান ৭০৩টি, ৩০টি এসএমজি, ১৩টি এলএমজি, ৮৯টি পিস্তল, ৫৬০টি পিস্তল, ১৫২টি গ্যাসগান ও তিনটি টিয়ারগ্যাস লঞ্চার। এ ছাড়া নরসিংদী কারাগারসহ সারাদেশের বিভিন্ন থানা ও ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে অসংখ্য অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করা হয়। সেগুলো উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত যৌথ বাহিনী অভিযান চলবে বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version