Homeঅন্যান্য খবরপ্রাকৃতিক দুর্যোগে ১ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ; বণ্যায় মৃতের সংখ্যা...

প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ; বণ্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৯

দেশের ১১ জেলায় উজানের ঢল ও বৃষ্টির পানিতে সৃষ্ট বন্যায় এ পর্যন্ত ৫৯ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, সর্বোচ্চ মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে ফেনীতে, ২৩ জন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন মৌলভীবাজার জেলার একজন। শুক্রবার ৫৪ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল মন্ত্রণালয়।
হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন। এরমধ্যে এখনো পানিবন্দি আছে ছয় লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫ পরিবার।
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্ততিতে বলা হয়েছে, ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারের ৬৮টি উপজেলা বন্যা প্লাবিত হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন ও পৌরসভার সংখ্যা ৫০৪টি।
মৃতদের মধ্যে পুরুষ ৪১ জন, নারী ৬ ও শিশু ১২ জন।

জেলাভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, কুমিল্লায় ১৪ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, খাগড়াছড়িতে ১ জন, নোয়াখালীতে ৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১ জন, লক্ষ্মীপুরে ১ জন কক্সবাজারে ৩ জন এবং মৌলভীবাজারে ১ জন মারা গেছেন।
উজানের তীব্র ঢল এবং অতি ভারি বৃষ্টির কারণে গত ২০ অগাস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।
পরে দ্রুতই তা ছড়িয়ে যায় ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজারে।
মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, পানিবন্দি-ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য দুর্গত এলাকাগুলো ৩ হাজার ৯২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ জন মানুষ রয়েছেন। আগের দিন যা ছিল ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৬৮৭ জন।
ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসা সেবা দিতে এসব এলাকায় ৫১৯টি মেডিকেল টিম কাজ করছে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়।
বন্যা আক্রান্ত এলাকায় চার কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা, ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল, ১৫ হাজার বস্তা ও প্যাকেট শুকনা খাবার ও পশু খাদ্য বাবদ নগদ ৩৫ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

চার মাসে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত:
এদিকে দেশে গত মে মাস থেকে চলতি আগস্ট পর্যন্ত চার মাসে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ১ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব দুর্যোগের মধ্যে ছিল ঘূর্ণিঝড় ও বন্যা। সবচেয়ে বেশি ৫৯ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাম্প্রতিক বন্যায়। জাতিসংঘের মানবিক–বিষয়ক সমন্বয় অফিস (ওসিএইচএ) শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছে।
আরেক প্রতিবেদনে জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলেছে, এবারের বন্যায় ২০ লাখের বেশি শিশু ঝুঁকির মধ্যে আছে। এই শিশুদের বড় অংশ এখনো অভিভাবকদের সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্র বা উঁচু জায়গায় অবস্থান করছে। বিগত ৩৪ বছরে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে এটি সবচেয়ে ভয়ংকর বন্যা। আর এ বছর এখন পর্যন্ত সব দুর্যোগ মিলিয়ে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা ৫০ লাখ।
ইউনিসেফ ছাড়াও দুর্যোগ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোর জোট ইন্টার কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ ও হিউম্যানিটারিয়ান টাস্কফোর্স টিম বাংলাদেশের বন্যা নিয়ে যৌথ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এতে বলা হয়, সর্বশেষ বন্যাকবলিত ১১টি জেলায় সাত হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে খাওয়ার পানির উৎস, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা, পাঠদান কক্ষসহ বেশির ভাগ অবকাঠামো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশির ভাগ স্কুলের বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।

 

বছরে দুর্যোগে যত ক্ষতি:

২০ আগস্ট থেকে দেশের দক্ষিণ ও উত্তর–পূর্বের ১১টি জেলায় প্রবল বর্ষণ শুরু হয়। এর সঙ্গে উজানের ঢল মিলে ব্যাপক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সর্বশেষ জানিয়েছে, বন্যায় ৫৪ জন মারা গেছে। বন্যায় আক্রান্ত জেলাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ফেনীতে ১৯ জন।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত ১১টি জেলার ৬৪টি উপজেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। জেলাগুলো হলো ফেনী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট। পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১০ লাখ ৯ হাজার ৫২২। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫৪ লাখ ৬৪ হাজারের বেশি।
ওসিএইচএর হিসাব অনুযায়ী, বন্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫৯ লাখ। এ সংখ্যা এ বছরের অন্য যেকোনো দুর্যোগে সর্বোচ্চ। এ বছর প্রথম বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘূর্ণিঝড় রিমাল। গত ২৬ মে এটি উপকূলে আঘাত করে। আক্রান্ত হয় ৪৬ লাখ মানুষ।
বৃহত্তর সিলেটে ১২ থেকে ১৯ জুন এবং ৪ থেকে ১১ জুলাই দুই দফায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরই মধ্যে দেশের উত্তরাঞ্চলে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে সৃষ্টি হয় বন্যা পরিস্থিতির। তবে সব দুর্যোগ ছাপিয়ে যায় চলমান বন্যা পরিস্থিতি।

ক্ষয়ক্ষতির মূল্যায়ন:

ওসিএইচএ বা সরকারি সূত্রে চলতি বন্যা নিয়ে যেসব হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তাতে ক্ষতি সম্পর্কে সঠিক চিত্র পাওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করেন দুর্যোগবিষয়ক বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এবারের বন্যায় কল্পনাতীত ক্ষতি হয়েছে। বন্যার ক্ষতির হিসাব তিন সপ্তাহ পর, এরপর দ্বিতীয় দফায় আট সপ্তাহ পর এবং ১২ সপ্তাহ পর করতে হয়। তখন সঠিক চিত্র পাওয়া যাবে।
বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ডিজাস্টার ফোরাম বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ পর্যবেক্ষণ করে। বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ডিজাস্টার ফোরামের সদস্যসচিব গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা ও খাগড়াছড়িতে ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ফেনীর ৬০ শতাংশ জমি বালুতে পূর্ণ হয়ে চাষাবাদের অযোগ্য হয়ে গেছে। মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা বিধ্বস্ত বাড়িঘর পাচ্ছে। বিস্তীর্ণ এলাকার সড়ক নষ্ট হয়ে গেছে। এসবের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আছে।

বন্যাকবলিত জেলা ও উপজেলা সংবাদদাতারা জানান, বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জে ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ভেসে উঠছে। এখন পর্যন্ত যে চিত্র, তাতে বেশি ক্ষতি হয়েছে মৎস্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ খাতের। এসব খাতে জেলা চারটিতে প্রাথমিক ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। বন্যায় কুমিল্লায় মৎস্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদের ক্ষতির পরিমাণ এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া ও আদর্শ সদর উপজেলার বেশির ভাগ ফসলি জমি পানির নিচে। মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন খামারিরা। মারা পড়েছে অসংখ্য গবাদিপশু। নোয়াখালীতে ডুবে গেছে ৮৫ হাজার ৩৭৯টি পুকুর, দিঘি ও মাছের খামার। মৎস্য খাতেই কেবল ৬১৫ কোটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয়ের করা প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের চার উপজেলা ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, মিরসরাই ও সীতাকুণ্ডে ১ হাজার ৩০০ কোটি ৬৪ লাখ টাকার ক্ষতির তথ্য পাওয়া গেছে।

আন্তর্জাতিক সহায়তার তাগিদ

এবার ১১ জেলায় যে বন্যা হয়েছে, তা মূলত হঠাৎ বন্যা। এর বৈশিষ্ট্য অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপকহারে প্লাবন হয় এবং দ্রুতই পানি নেমে যায়। কিন্তু হঠাৎ ব্যাপক প্লাবন হলেও পানি নামছে খুব ধীরে।
বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, অন্য সময়ের আকস্মিক বন্যার তুলনায় এবার পানি নেমে যাওয়ার হার কম।
পানি ধীরে নামার কারণ হিসেবে বন্যার শুরুতে পূর্ণিমার জন্য সাগরে অস্বাভাবিক জোয়ার, অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং উপদ্রুত এলাকার নদীগুলোর নাব্যতা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version