Homeমতামতশেখ হাসিনার শাসনাবসান একই সঙ্গে একটি সুযোগ এবং একটি ঝুঁকির মুহূর্ত

শেখ হাসিনার শাসনাবসান একই সঙ্গে একটি সুযোগ এবং একটি ঝুঁকির মুহূর্ত

শেখ হাসিনার শাসনাবসান তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, এটি বাংলাদেশের জন্য একই সঙ্গে একটি সুযোগ এবং একটি ঝুঁকির মুহূর্ত এনে দিয়েছে। বিষয়টি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হলে আমাদের বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিচার করতে হবে। আর ভারতের জন্য যেটি জরুরি, তা হলো বাংলাদেশকে আমাদের নিজেদের কাঠামোর মধ্যে ফেলে না দেখা।

নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশ যেন ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে তৎপর থাকা ভারতবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর মঞ্চে পরিণত না হয়, সে কারণেও দিল্লিকে বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগী হতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে হিন্দুদের বিরুদ্ধে যে কোনো সহিংসতা শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলবে না, এটি বাংলাদেশের রাজনীতিকেও প্রবলভাবে প্রভাবিত করবে। এসব যাতে না ঘটতে পারে, সে জন্য এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সেনাবাহিনী ও ছাত্র আন্দোলন ইতিবাচক ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, কর্তৃত্ববাদী দমন–পীড়ন শুধু একটি বিন্দু পর্যন্ত কার্যকর থাকে। তারপর আর তা কাজ করে না। আসলে ভিন্নমত হলো পানির মতো। পানি একটা নির্ধারিত অবস্থা পর্যন্ত আটকে রাখা যায়। পাত্রের ধারণক্ষমতার বেশি পানি ঢাললে তা উপচে পড়বেই। একইভাবে দমন দিয়ে একটা নির্ধারিত অবস্থা পর্যন্ত ভিন্নমতকে রোধ করা যায়। সেই অবস্থা পার হলে বিরোধিতা প্রচণ্ড বিদ্রোহ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

অনেকটা সে রকমভাবেই আমরা স্বাভাবিকের বাইরে গিয়ে অস্বাভাবিক মাত্রায় শেখ হাসিনার পাশে ছিলাম। আমরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে শুধু যে একটিমাত্র দলের পক্ষ নিয়েছিলাম তা-ই নয়, বরং আমরা সে দেশটির কর্তৃত্ববাদের অকুণ্ঠ সমর্থক হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছিলাম। বাংলাদেশে ভিন্নমত দমনের পরও ভারত বাংলাদেশের হাসিনা সরকারকে এতটাই পক্ষপাতমূলক সমর্থন দিয়ে এসেছিল যে সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যম পর্যায়ে আমরা এই দমন-পীড়নে সেখানকার সমাজে সৃষ্ট গভীর সংকটকে সমস্যা হিসেবে স্বীকারই করিনি।

ভারতে যাঁরা ডানপন্থী আছেন, তাঁরা বাংলাদেশের এই ঘটনাকে শুধু বিদেশি ষড়যন্ত্র কিংবা ইসলামপন্থীদের তৎপরতার ফ্রেমে আটকে বিচার করবেন। এর মাধ্যমে তাঁরা বাংলাদেশি জনগণকে অভ্যুত্থানের মূল কারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করবেন, সেটি নিশ্চিত। ভারতের ডানপন্থীরা ঠিক এই উপায়ে এখানকার ভিন্নমতাবলম্বীদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে থাকেন।

হাসিনা তাঁর নিজের দেশের শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকার’ বলে যে ভুল করেছেন, এটিও কিন্তু সেই একই ধরনের ভুল। বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি উত্তেজনাকর বিষয় ঘিরে আবর্তিত হয়ে আসছে।

প্রথমটি হলো, এটি ধর্মভিত্তিক নাকি ধর্মনিরপেক্ষ জাতি—সেই প্রশ্নের স্পষ্ট সমাধান দেশটির কাছে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই নেই। রাষ্ট্রটি গঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন শাসকেরা ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে জিয়াউর রহমানের কথা বলা যায়। তিনি সংবিধানে ইসলামি রং সংযোজন করার এবং ইসলামপন্থী দলগুলোকে অধিকতর স্থান করে দেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের সম্ভাব্য ধর্মনিরপেক্ষ ভবিষ্যতের অখণ্ডতাকে আঘাত করেছিলেন; কেননা ইসলামপন্থীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য শক্তি।

নাস্তিক ব্লগারদের বিরুদ্ধে ইসলামপন্থীদের বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনাও ইসলামপন্থীদের আংশিকভাবে জায়গা করে দিয়েছিলেন। তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করতে বানানো নিবর্তনমূলক আইনকে বৈধতা দিতে ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন, যা দিয়ে সহজেই ধর্মনিরপেক্ষ ভিন্নমতাবলম্বীদের ঘায়েল করা যায়। এ কারণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্ম একটি চাপ হয়ে থাকবে।

কর্তৃত্ববাদী শাসকেরা যখন নিজেদের রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন, তখন ধর্মীয় গোষ্ঠী শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আবার ধর্মনিরপেক্ষ ভিন্নমতাবলম্বীদের অনেক সময় এতটাই দমন করা হয় যে একমাত্র ধর্মীয় আন্দোলনই অসন্তোষ উপশমের একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সম্ভবত গণতান্ত্রিক পরিসর উন্মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসলামপন্থী দলগুলো কিছু সময়ের জন্য আরও ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠবে। কিন্তু তারপরও আধুনিকতার দিকে ধাবমান অন্য সব সমাজের মতো, এখানেও গণতন্ত্রের পরিসর উন্মুক্ত হলে সেটি দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্রকে সংহত করবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশের সামনে অনেক সুযোগ আছে।

বাংলাদেশে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মনিরপেক্ষ নাগরিক সমাজের সংগঠন রয়েছে। এই নাগরিক সমাজই দেশটির উন্নয়নের গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশের পক্ষে নিজেকে মুক্তি ও স্বাধীনতার একটি সম্ভাব্য অঞ্চল হিসেবে ভাবা সম্ভব; কারণ দেশটির জনগণ এটি উপলব্ধি করতে পারে যে জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রে ধর্মীয় মানদণ্ডকে গ্রহণ করলে তা আবার তাদের সংঘাত ও দমন-পীড়নের ঘূর্ণিপাকে ফেলে দেবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হলো দলীয় ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। এটি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম এবং প্রধান কাজ হবে অবাধ ও সুষ্ঠু একটি নির্বাচন নিশ্চিত করা, যাতে সব দল অংশগ্রহণ করতে পারে। আওয়ামী লীগ যদি আগামী নির্বাচন বর্জন করে বা নির্বাচনে যদি নামমাত্র ভোটার থাকে, তাহলে আবারও গণতান্ত্রিক উত্থান কর্তৃত্ববাদের দিকে মোড় নিতে পারে।

সমস্যাটি শুধু যে বাংলাদেশের বিজয়ী দলগুলোকে ক্ষমতার একচেটিয়া অধিকারকে ভোগ করতে দেয় তা না, বরং তা অবাধ নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিকে সংকীর্ণ করে ফেলে। একপর্যায়ে তা দেশকে কার্যত বিরোধী দলশূন্য করে ফেলে। এর ফলে ক্ষমতাসীন দলের মধ্যে (যেটি আমরা সম্প্রতি আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে দেখেছি) ছোট ছোট বলয় গড়ে ওঠে এবং সেগুলো একটি আরেকটির প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার ছায়া সরে গেলে, একটি প্রকৃত দলভিত্তিক ব্যবস্থার উদ্ভব হতে পারে। তবে ক্ষমতার পালাবদল ও ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয়টি মসৃণ করতে অধিকতর টেকসই দলভিত্তিক ব্যবস্থা তৈরি করা দরকার। তা না হলে এই আন্দোলনের উত্থান সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য গণতন্ত্রে রূপ নিয়ে আবার তা স্বৈরাচারী ব্যবস্থায় হারিয়ে যেতে পারে।

প্রতাপ ভানু মেহতা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস–এর কন্ট্রিবিউটিং এডিটর

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version