অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘বিপ্লবের সেন্টিমেন্ট’ বুঝে চলার আহ্বান জানিয়ছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, আজকে যারা উপদেষ্টা পরিষদের দায়িত্বে এসেছেন, তারা নিজেরা বসেনি, আমরা তাদের বসিয়েছি। কাউকে না কাউকে প্লেনের ককপিটে বসতে হবে যাত্রীকে গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
যারা বসেছেন, তাদের জানতে হবে তারা কি বিষয় নিয়ে বসেছেন, কি তাদের দায়িত্ব। আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখার পক্ষে। আমরা দেখতে চাই তারা সফল হয়েছেন। তারা সফল হলে বিপ্লব সফল হবে। তারা ভুল করলে, বিপ্লব ব্যর্থ হলে দায় তাদের ওপর অবশ্যই বর্তাবে। তারা ব্যর্থ হন, তা আমরা চাই না। এজন্য জনগণের পক্ষ থেকে তাদের আমরা অর্থবহ সহযোগিতা করতে চাই। শুধু বলবো, বিপ্লবের সেন্টিমেন্ট বুঝে যেন তারা চলেন। জনগণ এই বিপ্লবের যে চেতনা অন্তরে ধারণ করেছেন, তা যেন কখনো আপনারা (অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) ভুলে না যান। এখানে কারও খেয়াল-খুশি, ব্যক্তিগত ইচ্ছেমতো চলার বা বাস্তবায়ন করার কোনো সুযোগ নেই।
বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইডিইবি) কাউন্সিল হলে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শাখা আয়োজিত আইনজীবী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান।
সমাবেশে ডা. শফিকুর রহমান আরো বলেন, এই সরকারের কাছে অনেক প্রত্যাশা মানুষের। কিন্তু সব প্রত্যাশা যদি অনির্বাচিত একটি অন্তর্বর্তী সরকারই পূরণ করে দেয়, তাহলে নির্বাচিত সরকারের দরকার কি? তারা কি পারবে? এটা তারা পারবে না। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে দাবি উঠেছে, নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে হবে। আমরা বলেছি, একটি রোডম্যাপ হবে না, দুটি রোডম্যাপ দিতে হবে। প্রথম রোডম্যাপ হবে সংস্কারের। কি কি বিষয়ে সংস্কারের কাজ উনারা করবেন এবং সময়সীমা কি হবে এটা হবে একটি রোডম্যাপ। এটা যদি সফল হয়, তাহলে দ্বিতীয় রোডম্যাপ সফল হবে। প্রথমটা যদি সফল না হয়, তাহলে দ্বিতীয়টার কোনো প্রয়োজনই নেই। ওটা দিয়ে কিছুই হবে না।
তিনি আরও বলেন, এখান থেকে যদি চুল পরিমাণ বিচ্যুতি ঘটে, তাহলে জাতির সর্বনাশ তাদের হাত দিয়েই হবে। আমরা আশঙ্কা থেকে বাঁচতে চাই, এবং আশাবাদী হয়ে থাকতে চাই। এজন্য আমরা আহ্বান জানাবো অনতিবিলম্বে তারা সংস্কারের বিষয়টা নিয়ে ডায়ালগ ওপেন করে এর একটা উপসংহারে উপনীত হবেন এবং তখন তারা সেভাবেই এগুবেন। যদি এই রোডম্যাপ ধরে সংস্কার এগোয় আমরা বিশ্বাস করি খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না। একটি সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই এটি সম্ভব। এটা যখনই একটা পূর্ণতার পর্যায়ে পৌঁছে যাবে সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে দিতে হবে। আর দেরি করা যাবে না।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমার লজ্জা হয়। কোনো রাজনীতিবিদ, নেতা-নেত্রী পালিয়ে গিয়েছেন এই শব্দটা ব্যবহার করতে আমরা লজ্জা হয়। যারা জনগণের খেদমত করতে এসে জনগণের মালিক বনে গিয়েছিলেন, কেন তারা পালালেন, তাদের পালাতে হলো কেন? তারা জানেন, তারা কি পরিমাণ অপকর্ম করেছেন। তারা মানুষের ওপর জুলুম করেছে, মানুষের হক নষ্ট করেছেন, সম্পদ লুণ্ঠন করেছেন, দেশের বাইরে টাকা পাচার করেছেন, অন্যায়-অত্যাচার করেছেন। তাদের হাতে অত্যাচারিত হয়নি এমন একজন মানুষও বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি তারা তাদের নিজেদের ওপরও অত্যাচার করেছেন। তাদের নিজেদের কোন্দলে সাড়ে চারশোর মতো সহকর্মী তাদের হাতেই মারা গেছে। এরা কত ভয়ংকর। আপন কর্মীদের হত্যা করতে যাদের দ্বিধাবোধ হয় না, জনগণের বুকে ছুরি কিংবা গুলি চালাতে তাদের দ্বিধাবোধ হওয়ার কথা নয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নিহত-আহতদের প্রতি শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে জামায়াতের আমির বলেন, আমাকে সাংবাদিকরা কখনো কখনো প্রশ্ন করেন, এই আন্দোলনে আপনাদের (জামায়াতে ইসলামী) অংশগ্রহণ ছিল আমরা জানি। আপনাদের দলের কি পরিমাণ লোক শহীদ হয়েছেন? আমি তাদেরকে বলেছি, মাফ করবেন, এই প্রশ্নের জবাব সোজসাপ্টা আমার কাছে নেই। যারাই শহীদ হয়েছেন, তারাই আমার, তারাই আমাদের, তারাই গোটা জাতির। আমরা শহীদদের কোনো দলীয় সম্পত্তি বানাতে চাই না। শহীদরা গোটা জাতির সম্পদ এবং তারা জাতীয় বীর। এই মর্যাদাই তাদের দেখতে চাই। শহীদদের টাকা দিয়ে মাপা যাবে না। শহীদদের প্রতি ফোটা রক্তের দাম অকল্পনীয়।
তিনি আরও বলেন, যারা সরাসরি জুলুমের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং স্বৈরাচারের দোসর হিসেবে যারা পাশে থেকে সহযোগিতা করেছে, তাদের কোনো নৈতিক অধিকার নেই রাষ্ট্রীয় কোনো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় থেকে এই জাতির সেবা করার। তারা তাদের অপকর্মের কারণে এই নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। বরং তাদের অপকর্মকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যদি এমনটি করা হয়, তাহলে আগামীতে কোনো সরকার স্বৈরাচারী হতে পারবে না, আর স্বৈরাচারের দোসর হওয়ার দুঃসাহস কেউ দেখাবে না।
জামায়াদতর আমীট আরও বলেন, আমরা (জামায়াতে ইসলামী) আইন হাতে তুলে নেওয়ার পক্ষে নই। প্রতিহিংসা, প্রতিশোধের রাজনীতি আমরা চাই না। কিন্তু অন্যায়ের প্রতিকার আমরা চাই। সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হোক সেটা আমরা চাই। এরা (স্বৈরাচার ও তার দোসর) যদি রক্ষা পেয়ে যায়, তাহলে আগামীতে এই রাস্তা খোলা থাকবে। আর কিছুদিন পর পরই এমন গণঅভ্যুত্থানের প্রয়োজন হবে। আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, এটি যেন বাংলাদেশের জনগণের জন্য শেষ গণঅভ্যুত্থান হয়। আর যেন এত রক্ত ঢেলে দেওয়ার প্রয়োজন না হয়।
জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আমীর মো. নূরুল ইসলাম বুলবুলের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মাসুদের সঞ্চালনায় আইনজীবী সমাবেশে আরও উপস্থিত ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, জসিম উদ্দিন সরকার প্রমুখ।