Thursday, November 21, 2024
Homeজাতীয়আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ পাওয়া নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ

আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়োগ পাওয়া নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেছে। সংবিধান অনুযায়ী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নির্ধারণ করা থাকলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মাত্র আড়াই বছরেই বিদায় নিলো কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। একদলীয় নির্বাচন হওয়ায় ৭ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছিল স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘স্বদিচ্ছা থাকলেও বিভিন্ন কারণে স্বচ্ছ নির্বাচন দিতে অসমর্থ হয় কমিশন।’ শুধু নির্বাচন কমিশন পূণর্বিন্যাস না করে পুরো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) বলেন, ‘সরকার বারবার বলছে, ব্যাপক সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন বারংবার ব্যর্থ হওয়ার প্রকৃত সত্য ও কারণ এই কথাটির মধ্যেই নিহিত।’

বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১২টায় সংবাদ সম্মেলন করে সব কমিশনাররা একযোগে পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার সময় এসব কথা বলেন তিনি। পদত্যাগ করা সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের অন্যান্য কমিশনার হলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান, বেগম রাশিদা সুলতানা, মো. আলমগীর ও মো. আনিসুর রহমান।

সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান ও মো. আলমগীর উপস্থিত ছিলেন। তবে বেগম রাশিদা সুলতানা ও মো. আনিসুর রহমান উপস্থিত ছিলেন না। সংবাদ সম্মেলনে সিইসি পদত্যাগপত্র সই করে নির্বাচন কমিশন সচিব শফিউল আজিমের হাতে তুলে দেন। সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দ্রুত নির্বাচন কমিশন ভবন ত্যাগ করেন।

নির্বাচন কমিশনাদের পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে বলে দুপুর ২টার দিকে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইং থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র অনুযায়ী, বাংলাদেশে মোট ১৩টি কমিশনের মধ্যে ৬টি কমিশন মেয়াদ পূর্ণ করতে পেরেছে, আর বাকি ৭টি কমিশন নানা কারণে তাদের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি।

সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘সৌজন্য মতবিনিময়’ অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পাঠকালে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘প্রতিটি সাধারণ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে উদ্দেশ্য অর্জন আরও সুনিশ্চিত হতে পারে।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘পরিশেষে আপনাদের অবহিত করতে চাই, আমিসহ মাননীয় কমিশনাররা দেশের পরিবর্তিত বিরাজমান অবস্থায় পদত্যাগ করতে মনস্থির করেছি। আমরা অদ্যই (বৃহস্পতিবার) পদত্যাগপত্র মহামান্য রাষ্ট্রপতির সমীপে উপস্থাপনের নিমিত্তে কমিশনের সচিব মহোদয়ের হাতে দেব।’

সিইসি বলেন, ‘বাংলাদেশের ৫৩ বছরের ইতিহাসে কোনো নির্বাচন কমিশন সংবিধান উপেক্ষা করে স্বেচ্ছায় নির্বাচন না করে বা বাতিল করে দিয়ে পদত্যাগ করেছে এবং সেই কারণে নির্বাচন হয়নি এমন কোনো উদাহরণ নেই।’

হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান আগামীতে আমাদের দেশকে প্রবল সংস্কারের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সুন্দর একটি বাংলাদেশ সৃষ্টির যে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে সেই স্বপ্ন অচিরেই বাস্তবায়িত হবে, আমরা সবাই আশাবাদী। আগামী দিনের বাংলাদেশে প্রশাসন, বিচার, নির্বাচন সব কিছু অনেক সুন্দর হবে।’

প্রধান নির্বাচন কমিশনার উদাহরণ টেনে বলেন, ‘দেশের প্রথম সাংবিধানিক নির্বাচন ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচন নিয়েও ছিল অনেক বিতর্ক। ১৯৭৯ ও ১৯৮৭ সালের সাধারণ নির্বাচন সামরিক শাসন আমলে হয়েছে, ফলাফল নিয়ে ছিল বিতর্ক। ১৯৯১ এর নির্বাচন রাজনৈতিক রূপরেখার ভিত্তিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন সাংবিধানিক নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছিল। সূক্ষ্ম বা স্থূল কারচুপির সীমিত সমালোচনা সত্ত্বেও সার্বিকভাবে সুন্দর ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল।’

হাবিবুল আউয়াল আরও বলেন, ‘২০০৮ সালের নির্বাচন সেনা সমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে বিএনপি মাত্র ২৭টি ও আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসন পেয়েছিল। সেই নির্বাচনও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। নিরাপদ প্রস্থান (সেফ এক্সিট) বিষয়ে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সেনা সমর্থিত অসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দর কষাকষির বিষয়টি প্রকাশ্য ছিল। সেই প্রশ্নে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের অবস্থানও গোপন ছিল না। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচন সংবিধান মতে দলীয় সরকারের অধীনে হলেও ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপিসহ অনেক দল অংশগ্রহণ করেনি। ফলে সেই নির্বাচন ২০২৪ সালের অনুরূপ অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল না। ২০১৮ সালের নির্বাচন বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে, নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল। বিএনপি আসন পেয়েছিল মাত্র ৬টি, আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৫৮টি।’ এই বিষয়ে কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন বলে যোগ করেন তিনি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে বা ব্যবস্থাপনায়। ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮টি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও প্রধানতম বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচন সেই অর্থে অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। কমিশন বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য একাধিকবার আহ্বান করা সত্ত্বেও তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা বা না করার বিষয়টি একটি রাজনৈতিক দলের নিজস্ব বিষয়।’

নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেয়ার মতো ‘কোনো সাংবিধানিক ভিত্তি ছিল না’ উল্লেখ করে বলেন, ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে তাই অনেকে কমিশনকে দোষারোপ করছেন। নির্বাচন কখন কী কারণে কত দিনের জন্য স্থগিত করা যাবে তা সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে।’ অতীতে কখনোই কোনো নির্বাচন বাতিল করে দিয়ে কোনো কমিশন পদত্যাগ করেননি বলে দাবি করেন তিনি।

সিইসি বলেন, ‘দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন মূলত একদলীয় হওয়ার কারণে কারচুপি বা সরকারিভাবে প্রভাবিত করার প্রয়োজন ছিল না। আমি স্পষ্ট করে বলছি, নির্বাচন যেহেতু একদলীয় ছিল, কাজেই এই নির্বাচনকে সরকারিভাবে প্রভাবিত করা কোনো আবশ্যকতা কার্যত ছিল না। নির্বাচন দলের ভেতরেই হয়েছে, মধ্যে হয়নি।’

নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হওয়ার সব দোষ ও দায়-দায়িত্ব সবসময় কেবল নির্বাচন কমিশনের ওপর এককভাবে আরোপ করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘একটি কমিশন না হয় অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। কিন্তু সবসময় সব কমিশনই অসৎ বা পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে না। কমিশন বিভিন্ন কারণে নির্ভেজাল, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অক্ষম বা অসমর্থ হতে পারে। বিদ্যমান ব্যবস্থায় আমাদের বিশ্বাস, কেবল কমিশনের পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে অবাধ, নিরপেক্ষ, কালো টাকা ও পেশিশক্তি-বিবর্জিত এবং প্রশাসন ও পুলিশের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতিতে মৌলিক সংস্কারের প্রয়োজন হবে। রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও আচরণে এবং বিশেষত প্রার্থীদের আচরণে পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়োজন হবে।’

তিনি বলেন, ‘১৯৭৩ থেকে হওয়া অতীতের সব নির্বাচন ছাড়াও ২০০৮, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের বিতর্কিত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে কমিশন পরবর্তী সব নির্বাচনগুলো সতর্কতার সঙ্গে আয়োজনের চেষ্টা করেছে।’

হাবিবুল আউয়াল জানান, তার কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের পর দুবছরে ইউনিয়ন পরিষদের ৯৯২টি, উপজেলা পরিষদের ৪৯৬টি, জেলা পরিষদের ৭১টি, পৌরসভার ৯০টি এবং সিটি করপোরেশনের ১৬টি নির্বাচন করেছে। উপনির্বাচনসহ জাতীয় সংসদের মোট ৩১৮টি আসনে নির্বাচন করেছে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments