অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বর্তমান সরকার মুক্ত গণমাধ্যমে বিশ্বাস করে এবং দেশে একটি গতিশীল ও প্রাণবন্ত গণমাধ্যম দেখতে চায়। রাষ্ট্র মেরামতের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের জন্য জাতীয় ঐক্যের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় প্রধান উপদেষ্টা এ কথা বলেন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্র মেরামত করার জন্য মস্তবড় সুযোগ এনে দিয়েছে। বাংলাদেশকে নতুন শিখরে নেওয়ার জন্য এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। তবে এর জন্য জাতীয় ঐক্যের খুবই প্রয়োজন।
সভা শেষে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ-প্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীরও উপস্থিত ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে শফিকুল আলম বলেন, সরকার দেশে একটা গতিশীল গণমাধ্যম দেখতে চায়। এর জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবটুকু করা হবে। একইসঙ্গে সরকার দেশে মুক্ত গণমাধ্যমের প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে উল্লেখ করেন।
মতবিনিময় সভায় সম্পাদকগণ সাংবাদিকদের জন্য যেসব কালাকানুন আছে সেগুলো বাতিল বা সংশোধনের প্রস্তাব করেন।
সরকারের পক্ষ থেকে মিডিয়ার ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম মজুমদার বলেন, একটি প্রাণবন্ত ও মুক্তগণমাধ্যমের জন্য মিডিয়া কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। এই কমিশন আমাদের দেশে মিডিয়া কিভাবে চলবে তা ঠিক করবে।
তিনি বলেন, সাংবাদিকতা করতে গিয়ে কেউ যেন বিপত্তির মুখে না পড়ে, বাধার সম্মুখীন না হন তা নিশ্চিতে এই কমিশন গঠনের প্রস্তাব এসেছে। সরকার এই কমিশন গঠনের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে।
রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার সম্পর্কে প্রেস সচিব বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং রাজনৈতিক নেতারা অধ্যাপক ইউনূসকে ‘যৌক্তিক সময়সীমার’ মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করতে বলেছেন।
তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস সম্পাদকদের কাছে যৌক্তিক সময় কতদিন হওয়া উচিত তা জানতে চেয়েছেন। অধিকাংশ সম্পাদক একমত হয়েছেন যে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পাদন করতে যতটা সময় পর্যন্ত হওয়া উচিত।
শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন যে, ছাত্র-জনতার বিপ্লব রাষ্ট্র মেরামতের একটি সুযোগ তৈরি করেছে এবং এটিকে কাজে লাগাতে হবে। অধ্যাপক ইউনূস সংস্কারগুলোকে টেকসই করতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।
বৈঠকে তিনি বলেন, সম্পাদকরা সংবিধান সংস্কার এবং আইন কমিশন ও পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সংস্কার নিয়েও কথা বলেছেন। সম্পাদকরা উপদেষ্টা পরিষদ আরও সক্রিয় করার এবং ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ দিয়েছেন উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, তারা দেশের সংবিধান পুনর্লিখনের জন্য একটি সাংবিধানিক সভা করার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন।
মতবিনিময় সভায় অংশ নেওয়া সম্পাদকরা যত শীঘ্র সম্ভব সংস্কার কার্যক্রম বা কার্যপদ্ধতি ঠিক করে ফেলার পরামর্শ দেন।
সভায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, ডেইল স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, দ্য নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পাদক এনাম আহমেদ, কালবেলা সম্পাদক সন্তোষ শর্মা, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশীর সকলকে সাধারণ ক্ষমা মঞ্জুর করেছে।
তিনি জানান, সংযুক্ত আরব আমিরাতের ফেডারেল আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশীকে মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান ক্ষমা করেছেন। তবে সাজা মওকুফ করা হলেও তাদের সেদেশে না রেখে শীঘ্রই বাংলাদেশে পাঠানোর কথা জানিয়েছে দেশটি।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে যমুনার গেটে সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের কাছে উনার (প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস) আবেদন হচ্ছে আমরা যেন লেখনির মাধ্যমে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করি। আমাদের সাজেশন উনি সাদরে গ্রহণ করেছেন। আমাদের বলেছেন, সরকার পরিচালনায় ভুল-ত্রুটি হলে আমরা যেন নির্দ্বিধায় কাগজে ছাপি।
উনার সরকারকে সহযোগিতা করি। সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন এটা তার সরকারের পলিসিগত (সাংবাদিকদের নামে মামলা) না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ডে সম্পাদকেরা একাত্মতা পোষণ করেছেন বলে জানান মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হোক।
সেখানে আমি একজন সম্পাদক হিসেবে যেটা উত্থাপন করেছি, সেটা হচ্ছে সাংবাদিকদের নিশ্চয়তা এবং তাদের ব্যাপারে যেভাবে যত্রতত্র খুনের মামলা হচ্ছে সেটা যাতে বন্ধ হয় এবং সরকার যেন সুস্পষ্ট অবস্থান নেয়। সাংবাদিকদের যদি দোষ থাকে, তারা যদি দুর্নীতি করে থাকে তাহলে আলাদা মামলা হতে পারে। কিন্তু, এইভাবে (ঢালাও খুনের মামলা) যেন না হয়।
আলোচনায় জাতীয় ঐক্যের কথা উঠে এসেছে জানিয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশে একটা জাতীয় ঐক্য স্থাপিত হোক। রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত জাতি যেন ঐক্য স্থাপন করতে পারি। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সম্পাদকেরা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আশা করেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সংস্কারের মধ্যে সংবিধান পরিবর্তন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা। স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো আছে দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠন করে সত্যিকার অর্থে গণমুখী সংস্থায় পরিণত করা।
ভবিষ্যতে সব নির্বাচনে জাতির এবং ভোটারদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটান এমন নির্বাচন কমিশন চাই। দেশে যে দুর্নীতি হয় সেটা যেন স্বাধীনভাবে দুদক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়।
তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি উনি একটা ভাইব্রেন্ট মিডিয়া চান। আমাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। মিডিয়াবান্ধব সরকার যদি কখনো থেকে থাকে তাহলে আমরা এখন পেয়েছি। এর জন্য আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে যতগুলো কালো আইন রয়েছে, (যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট) যেগুলোতে সাংবাদিকদের নিপীড়নের অধ্যায় রয়েছে, সেগুলো কার্যত হবে না এবং এটা পুনর্গঠন উনারা সময় নিয়ে করবেন।’
সরকারের মেয়াদ কতদিন থাকবে তা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে মাহফুজ আনাম বলেন, সরকারের মেয়াদ কতদিন হতে পারে সেটা প্রধান উপদেষ্টা আমাদের জিজ্ঞেস করেছেন। এটা নিয়ে অনেকেই অনেক মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন সময়। কিন্তু মূল কথা যেটা এসেছে, সেটা হলো সরকারের এজেন্ডা কী? সেই অনুপাতে সময়।
অনেক রাজনৈতিক দল বলেছেন আপনাদের (সরকার) যতদিন দরকার লাগে, কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলেছে যৌক্তিক সময়। এগুলো তো অস্পষ্ট। প্রধান উপদেষ্টার ইচ্ছা খবরের কাগজের মাধ্যমে আমরা একটা ধারণা দেই যাতে জাতি কী চায়, কয় বছর হতে পারে, দুই, তিন, পাঁচ বছর। এটা নিয়ে উনার কোনো নিজস্ব চিন্তা নেই। প্রধান উপদেষ্টা চান জনতার চিন্তাটা জানতে। সেই ব্যাপারে তিনি গণমাধ্যমকে আহ্বান জানিয়েছেন, আমরা যেন গণমাধ্যম হয়ে জনগণের কথা লিখি।