অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যে স্বপ্ন নিয়ে ছাত্র–জনতা স্বৈরাচার পতনের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, সেই স্বপ্ন পূরণে তিনি অঙ্গীকারাবদ্ধ। আজ রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তাঁর এই ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শপথ নেওয়ার ১৫ দিনের মাথায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে আন্দোলনে নিহত ছাত্র–জনতাকে স্মরণ এবং বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে তাঁদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে ভাষণ শুরু করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরাচারের হাতে দেশের সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে।
এতদিন দেশে যেভাবে দুর্নীতি হয়েছে, তা বোঝাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পিওনেরও ৪০০ কোটি টাকার মালিক হওয়ার তথ্য তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে স্বৈরাচার তাঁর নিজের, পরিবারের ও দলের কিছু মানুষের স্বার্থ হাসিলের পথ তৈরি করে দিয়েছে।
আর্থিক খাত ও শেয়ার বাজারে লুটপাটের কথা উল্লেখ করেন তিনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘গণরোষের মুখে ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ ত্যাগ করার পর আমরা এমন একটি দেশ গড়তে চাই যেখানে প্রতিটি নাগরিকের মানবাধিকার থাকবে পুরোপুরি সুরক্ষিত। আমাদের লক্ষ্য একটিই— উদার, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আমরা এক পরিবার। আমাদের এক লক্ষ্য। কোনো ভেদাভেদ যেন আমাদের স্বপ্নকে ব্যাহত করতে না পারে সেজন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’
ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বর্তমান সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করার মাত্র দুই সপ্তাহ শেষ হলো। কর্ম যাত্রার প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে আপনাদের কাছ থেকে যে সমর্থন পাচ্ছি সেজন্য আন্তরিক ধন্যবাদ। আমরা অনুধাবন করছি যে আমাদের কাছে আপনাদের প্রত্যাশা অনেক। এ প্রত্যাশা পূরণে আমরা বদ্ধপরিকর। যদিও দীর্ঘদিনের গণতন্ত্রহীনতা, ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থা প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমাদের জন্য পর্বতসম চ্যালেঞ্জ রেখে গিয়েছে। কিন্তু এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে আমরা প্রস্তুত। আজ আমি সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করতে আপনাদের সামনে এসেছি। শুধু আমি বলবো আপনাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
সবাইকে ধৈর্য ধরে নতুন বাংলাদেশ গড়তে সরকারকে সহযোগিতা করার আহ্বান জানিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এখনই সব দাবি পূরণ করার জন্য জোর করা, প্রতিষ্ঠানে ঢুকে ব্যক্তিবিশেষকে হুমকির মধ্যে ফেলা, মামলা গ্রহণের জন্য চাপ সৃষ্টি করা, বিচারের জন্য গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আদালতে হামলা করে আগেই একধরনের বিচার করে ফেলার যে প্রবণতা তা থেকে বের হতে হবে। ছাত্র–জনতার বিপ্লবের গৌরব ও সম্ভাবনা এসব কাজে ম্লান হয়ে যাবে, নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রচেষ্টাও এতে ব্যাহত হবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন. ছাত্র-জনতার স্বপ্নপূরণে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন তিনি বলেন, দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে আমরা সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।
ড. ইউনূস বলেন, একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে এই দায়িত্বে এসেছি।
দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, একটা বিশেষ ব্যাপারে আমরা আপনাদের সহযোগিতা চাচ্ছি। আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ- কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই। আইনসঙ্গতভাবে যা কিছু করার আছে আমরা অবশ্যই তা করব।
ড. ইউনূস বলেন, আমাদের ঘেরাও করে আমাদের কাজে বাধা দেবেন না। সবাই মিলে তাদের বোঝান তারা যেন এ সময়ে তাদের অভিযোগের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের দৈনন্দিন গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাধা না দেন।