শেখ হাসিনা গত সোমবার দেশত্যাগের আগের দিন রোববার জেনারেলদের নিয়ে একটি বৈঠক করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেই বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হয়, সোমবার থেকে দেশব্যাপী ডাকা কারফিউ বাস্তবায়নে সেনাসদস্যরা জনগণের ওপর কোনো গুলি চালাবে না। সেনাপ্রধান এই সিদ্ধান্তের কথা গণভবনে শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স শেখ হাসিনার শাসনের শেষ ৪৮ ঘণ্টার পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত সপ্তাহের ঘটনাবলি সম্পর্কে জানেন এমন চারজন সেনা কর্মকর্তা এবং এসব ঘটনা কাছ থেকে দেখেছেন এমন দুটি সূত্রসহ ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। সংবেদনশীলতা বিবেচনায় তাঁদের অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সোমবার সকালে শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে যান। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি জানান, দেশজুড়ে যে কারফিউ জারি করা হয়েছে, তা বাস্তবায়নে তাঁর সেনারা অপারগ। বিষয়টি সম্পর্কে জানেন এমন একজন ভারতীয় কর্মকর্তা এ তথ্য জানিয়েছেন।
ওই ভারতীয় কর্মকর্তা বলেন, সেনাবাহিনীর বার্তাটি পরিষ্কার ছিল। শেখ হাসিনার প্রতি আর সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল না।
ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যকার বৈঠকের বিশদ বিবরণ ও শেখ হাসিনার কাছে দেওয়া বার্তা আগে প্রকাশিত হয়নি। সেনা কর্মকর্তাদের ওই বৈঠক আর শেখ হাসিনার কাছে সেনাপ্রধানের বার্তায় ফুটে উঠেছিল, তিনি সেনাবাহিনীর সমর্থন হারিয়েছেন।
এমন পরিস্থিতিতে গত সোমবার শেখ হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে তাঁর বিশৃঙ্খল শাসনকাল বলতে গেলে পলকেই শেষ হয়ে যায়।
গত রোববারের সংঘর্ষে অন্তত ৯১ জন নিহত ও শতাধিক আহত হওয়ার পর দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করা হয়। জুলাইয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভ শুরু হওয়ার পর এ দিনই সবচেয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটে।
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী রোববার সন্ধ্যার আলোচনার বিষয়ে বলেন, ‘এটি একটি নিয়মিত বৈঠক ছিল। যেকোনো বিশৃঙ্খলার পর হালনাগাদ তথ্য নিতে নিয়মিত এমন বৈঠক করা হয়।’ সেই বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে আরও প্রশ্ন করলে তিনি বিস্তারিত জানাননি।
পদত্যাগ ও দেশত্যাগের বিষয়ে জানতে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি রয়টার্স। তাঁর ছেলে ও উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে জার্মান গণমাধ্যম ডয়চে ভেলেতে গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘শেখ হাসিনা এক দিন আগেই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিষয়টি আমরা কয়েকজনই কেবল জানতাম। সংবিধান অনুযায়ী যাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়, সেটিই ছিল তাঁর পরিকল্পনা। তবে যখন তারা (বিক্ষোভকারীরা) গণভবনের দিকে মার্চ করা শুরু করল, তখন আমরা ভয়ে বললাম, আর সময় নেই। (আমরা তাকে বললাম) তোমাকে এখনই বেরিয়ে যেতে হবে।’
শেখ হাসিনা গত ৩০ বছরের মধ্যে ২০ বছর বাংলাদেশ শাসন করেছেন। গত জানুয়ারিতে তিনি চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হন। এর আগে হাজারো বিরোধী নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রধান বিরোধীরা এই নির্বাচন বর্জন করেছিল।
শেখ হাসিনার প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারের বিষয়ে এখনো প্রকাশ্যে কোনো ব্যাখ্যা দেননি ওয়াকার-উজ-জামান। কিন্তু বাংলাদেশের তিন সাবেক জ্যেষ্ঠ সেনা কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, বিক্ষোভের মাত্রা ও অন্তত ২৪১ জন মানুষ নিহত হওয়ার পর হাসিনাকে আর সমর্থন করা যায় না।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘সেনাদের মধ্যে অনেক অস্বস্তি ছিল। সেটিই সম্ভবত সেনাপ্রধানের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। কারণ, সেনারা বাইরে ছিলেন। যা ঘটছিল তাঁরা তা দেখছিলেন।’
সোমবার শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশত্যাগের দিন হাজার হাজার মানুষের সাথে কারফিউ অমান্য করে অবসরপ্রাপ্ত কিছু সেনা কর্মকর্তারাও রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। তাদের কয়েকজন রয়টার্সকে জানান, এ দিন সেনাসদস্যরা বিক্ষোভকারীদের কোনো বাধা দেয়নি।