কাগজ কিংবা কাপড়ের চেয়ে ঢের টেকসই প্লাস্টিক। এ কারণে সবার পছন্দ পণ্যে প্লাস্টিকের মোড়ক। অনেক দেশ পরিবেশ ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এই প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করলেও বাংলাদেশ হাঁটছে উল্টো পথে। প্লাস্টিক উৎপাদন ও ব্যবহার দ্রুতলয়ে বাড়তে থাকলেও তা প্রশমনে নেই কোনো উদ্যোগ। ফলে মাটি, পানি, বায়ুসহ প্রকৃতিতে প্লাস্টিক দূষণ পেয়েছে নতুন মাত্রা। প্লাস্টিক বিষে নীল প্রাণিকুলও। মাছের পেট থেকে মানুষের পেটেও যাচ্ছে প্লাস্টিক।
অথচ ২০০২ সালে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করেছিল। আর দেশের উপকূলীয় এলাকার হোটেল, মোটেল ও রেস্তোরাঁয় একবার ব্যবহারের পর বর্জ্য হয়ে যায় এমন প্লাস্টিক সামগ্রীর ব্যবহার বন্ধের নির্দেশনাও দেওয়া আছে হাইকোর্টের। তবে সেই নির্দেশনার নেই কোনো বাস্তবায়ন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের গত বছরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ মাছে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। গবেষণার সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বলেন, ‘আমরা ১৮ প্রজাতির ৪৮টি মাছ নিয়ে পরীক্ষা করি। এর মধ্যে ১৫ প্রজাতির (৭৩ শতাংশ) মাছের পরিপাকতন্ত্রে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণার অস্তিত্ব মিলেছে। ঢাকার কাছে সাভার ও আশুলিয়ার দুটি বাজার থেকে এসব মাছ কেনা হয়। যা দেশের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর ও জলাশয়ের স্বাদু পানিতে পাওয়া যায়।
অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বলেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। আকারে এটি সর্বোচ্চ পাঁচ মিলিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে। যা বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য পানিতে ফেলে দিলে ফটোকেমিক্যালি ও বায়োলজিক্যালি ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়। এ ছাড়া টুথপেস্ট ও ফেসওয়াশের মতো ভোগ্যপণ্যের প্লাস্টিকে ছোট ছোট বীজ থাকে। এগুলো পানিতে গেলে মাছ খাবারের সঙ্গে ভুল করে খেয়ে ফেলে। এভাবে মাছের শরীরে প্লাস্টিক চলে যায় মানুষের দেহে। এতে ক্যানসারসহ নানা রোগ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মুদি দোকান থেকে কেনা পণ্য বহন করার জন্য যেসব ব্যাগ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো প্রকৃতিতে মিশে যেতে ২০ বছর সময় লাগে। চা, কফি, জুস কিংবা কোমল পানীয়ের জন্য যেসব প্লাস্টিকের কাপ ব্যবহার করা হয়, সেগুলো ৫০ বছর পর্যন্ত টিকে থাকে। আর প্লাস্টিক বোতল ৪৫০ বছর পর্যন্ত পচে না।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষা বলছে, বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও বাংলাদেশে ১৫ বছরে (২০০৫ থেকে ২০২০ সাল) প্লাস্টিকের ব্যবহার তিন গুণ বেড়েছে। ২০২০ সালে ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন প্লাস্টিকের ব্যবহার হলেও এর মধ্যে মাত্র ৩১ শতাংশ পুনর্ব্যবহার হয়েছে। বাকিগুলো ভাগাড়, নদী, খাল, নর্দমা ও যত্রতত্র ফেলা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংকট প্লাস্টিক দূষণকে আরও খারাপ করেছে। মাস্ক, গ্লাভসসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীতে প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে। এসব বর্জ্য আলাদা করা হচ্ছে না। ২০২০ সালে কৃষি, ইলেকট্রনিক্স, পরিবহন, আসবাব, ভবন নির্মাণ, গৃহস্থালি, চিকিৎসা, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন খাতে ১৪ লাখ ৯ হাজার টন প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়েছে। এদিকে ঢাকায় দৈনিক ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে।
প্লাস্টিকের ব্যবহার বহুগুণ বাড়লেও বাড়ছে না সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। অবশ্য সম্প্রতি আকিজ গ্রুপ ও প্রাণ-আরএফএলসহ বেশকিছু দেশীয় কোম্পানি প্লাস্টিক রিসাইকেল প্ল্যান্ট চালু করেছে। তবে এটি উৎপাদনের চেয়ে অনেক কম। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে মোট প্লাস্টিকের মাত্র ৩৬ শতাংশ বর্জ্য রিসাইকেল বা পুনর্ব্যবহার হচ্ছে। আর প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল হয় প্রায় ৭০ শতাংশ।
এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) সেক্রেটারি জেনারেল শাহরিয়ার হোসেন বলেন, দেশে ‘প্লাস্টিক দুর্যোগ’ ক্রমে ভয়ংকর হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে প্লাস্টিক ব্যবহারে গতি এসেছে। তবে এর ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো কাজই হয়নি। আবার যে প্লাস্টিক পুনরায় ব্যবহার করা যায়, সেটিও পরিবেশে থেকে যাচ্ছে। এখন সবকিছুর রংবেরঙের মিনি প্যাক তৈরি হচ্ছে। যত বেশি রং, তত বেশি কেমিক্যাল। মিনি প্যাক কোনোভাবেই পুনরায় ব্যবহার করা যায় না। প্লাস্টিক তৈরিতে প্রায় ৩৮ ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৮টি অত্যন্ত ক্ষতিকর। প্লাস্টিক পরিবেশ থেকে কখনো হারিয়ে যায় না। একসময় আমাদের খাদ্যের সঙ্গে মিশে যায়। তিনি বলেন, এখনই কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হবে।
প্রতিবছর ৯ লাখ টন প্লাস্টিক আমাদের সাগর-মহাসাগরে যাচ্ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে ২০২৬ সালে এটা হবে এক কোটি ১৮ লাখ টন। বাড়ার এ প্রবণতা হলো প্রতি ১১ বছরে প্রায় দ্বিগুণ। আবার প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করার সময় অব্যবস্থাপনার জন্য প্লাস্টিকের প্রচুর কণা আমাদের মাটি, পানি, পরিবেশ ও দিনশেষে খাদ্যের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। অনেকে মনে করেন, এতে তেমন কিছু হচ্ছে না। মনে রাখতে হবে, গত ১৫ বছরে ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৫ গুণ বেড়েছে। এখন শিশুরাও ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। আসলে প্লাস্টিকের রিসাইকেলও কোনো সমাধান নয়। প্লাস্টিক ঘুরেফিরে পরিবেশে থেকে যায়। তাই ধীরে ধীরে একবার ব্যবহারযোগ্য এবং শেষ পর্যন্ত প্লাস্টিকের ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার বলেন, প্লাস্টিক মোকাবিলা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। অভিযান ও প্রচারণা চালিয়েও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা যাচ্ছে না। আমরা এখন আরও কঠোর হতে যাচ্ছি। এখানে যারা এসব পণ্য উৎপাদন করে, তাদের চিহ্নিত করেছি। আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সমাধান হবে বলে আশা করি। এ লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ১০ বছরের জন্য একটি ‘প্লাস্টিক পরিকল্পনা’ তৈরি করেছি।
লেখক: জাহিদুর রহমান,সূত্র:সাম্প্রতিক দেশকাল।