মানুষ সামাজিক জীব। তাই মানুষ নিজেদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করতে পারে না বরং একে অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। আদিম যুগে মানুষ একাকী বসবাস করত। ফলে মানুষ হাজারও রকমের বিপদে-আপদে নিমজ্জিত হতো।
অবশেষে যখন একে-অপরের সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে নিরাপত্তা বাহিনী গড়ে তুলল এবং একে-অপরকে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতে থাকল, তখন একই স্থানে একাধিক মানুষের বসবাস গড়ে উঠল। তখন থেকেই মানুষ সমাজবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করল। সংঘবদ্ধভাবে জীবন পরিচালনা করা ইসলামের নির্দেশনা। তাদের কাছে একে-অপরের অধিকার সুরক্ষিত থাকে। তারা একে-অপরের কাছে বিশ্বস্ত হবে।
ইসলামি শরিয়তে মুমিনের পারস্পরিক সম্পর্ক হলো একটি দেহের মতো। দেহের একটি অঙ্গ যে কোনো ধরনের বিপদে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্য অঙ্গ তাকে সাহায্যের জন্য তৈরি হয়। অনুরূপ কোনো মুসলমান ভাই যখন কোনো ধরনের বিপদে পড়েন, তখন অপর মুসলমান ভাইয়ের কর্তব্য তাকে সাহায্য করা। কেন না, যে মানুষকে সাহায্য করে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন। বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনে রয়েছে নানাবিধ ঝুঁকি ও বিপদ। দলবদ্ধতা কোনো মানুষ যদি কোনো দোষ-ত্রুটি করে বসে, তবে জামাতের অন্য লোক তাকে সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেবে।
জীবন চলার পথের নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হলে তা তুলে ধরবে এবং সমাধানও দেওয়ার চেষ্টা করবে। মুসলিম জাতি সর্বদা ঐক্যবদ্ধ থাকবে এবং সেই ঐক্যবদ্ধ জামাতের ওপর আল্লাহর হাত এবং বিছিন্নতাবাদীদের জন্য জাহান্নাম রয়েছে। যারা জামাতবদ্ধভাবে জীবনযাপন করে, তারা আল্লাহর বিশেষ রহমতের মধ্যে থাকেন। রাসূল (সা.) দলবদ্ধতা হয়ে বসবাস করার নির্দেশ দিয়েছেন। যারা জান্নাতের মধ্যখানে বসবাসের প্রত্যাশা করেন, তারা যেন দলবদ্ধতা হয়ে বসবাস করেন।
দলবদ্ধতা একটি দেহের মতো। যদি সেখানে মুমিন বান্দা সমবেত থাকেন। মুমিন বান্দা পরস্পর সহযাত্রী হয়ে একটি গৃহের মতো সুদৃঢ় থাকবে। দলবদ্ধ সব মুসলমান একে-অপরের ভাই ভাই। সুতরাং সে অপর ভাইয়ের কাছে সুরক্ষিত ও নিরাপদ থাকবে। আর এ মুমিন ভাইদের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ, মুমিন বান্দারা একতা ও দলবদ্ধতার ওপর অবিচল থাকবে। কিন্তু কোনো বান্দা গোমরাহির ওপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না।
মুসলিম ভাইয়ের বৈশিষ্ট্য হলো তারা একে অপরের প্রতি দায়িত্ববান। সবাই সবার প্রতি দায়িত্ববান আচরণ করবে। তারা কেউ কাউকে অসম্মান করবে না, জুলুম করবে না, লজ্জিত করবে না, অযথা রেগে যাবে না। কোনো ভাই অসুস্থ হলে অন্যের দায়িত্ব পড়ে যায় তাকে সুস্থ করা ও চিকিৎসা করা, কষ্ট পেলে সান্ত্বনা দেওয়া, বিপদে সাহায্য করা। একজন বন্ধু কোনো বিপদে পড়লে তাকে তা থেকে উদ্ধার করা। যদি তার পরিবার বিপদে পড়ে, তবে সামাজিকভাবে সাহায্য করা। যদি কোনো মুসলিম পারস্পরিক সাহায্য না করে তবে তার পরকাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এমনকি একটা পশু বিপদে পড়লেও এ সমাজের মানুষের কর্তব্য হলো তাকে উদ্ধার করা। উত্তম সমাজে প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতি দায়িত্বশীল হবে এবং একে-অপরের জানমাল ও ইজ্জত রক্ষার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে। মুসলিম উম্মাহ দলবদ্ধ জীবনযাপন করবে। তা যে কোনো জনপদেই হোক না কেন। এমনকি যদি কোনো সমাজে বা জনপদে মাত্র তিনজন লোকও থাকে; তবে তারা যেন একজনকে নেতা বানিয়ে পরামর্শের আলোকে জীবন পরিচালনা করে।
এখন মুসলিম সমাজের ঐক্যের অভাবই বেশি পরিলক্ষিত হয়। মুসলিম জাতি এক প্রাণ, এক দেহ-এ চেতনাবোধ দিনে দিনে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। ইসলামে মুসলমানদের পারস্পরিক সর্ম্পক ভ্রাতৃত্বের। এ সম্পর্কের ভিত্তি ইসলামের একটি স্তম্ভের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যে কেউ তার স্বীকৃতি দেবে সেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হবে। এ ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে মহান আল্লাহতায়ালা এবং রাসূল (সা.) জোর তাগিদ দিয়েছেন।
কুরআন ও হাদিসে বহু জায়গায় দলবদ্ধতা জীবনে গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে। সমাজবদ্ধ জীবনযাপনকারী ব্যক্তি একাকী জীবনযাপনকারীর ব্যক্তির তুলনায় অনেকগুণ বেশি নিরাপদ। দলবদ্ধভাবে জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের ওপর আল্লাহর সেই নেয়ামতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তরসমূহে মহব্বত পয়দা করে দিলেন। তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা অগ্নি গহ্বরের কিনারায় অবস্থান করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদের সেখান থেকে উদ্ধার করলেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় আয়াতগুলো ব্যাখ্যা করেন, যাতে তোমরা সুপথপ্রাপ্ত হও।’ (আলে ইমরান : ১০৩)।
এখানে আল্লাহর রজ্জু বলতে পবিত্র কুরআনকে বোঝানো হয়েছে। এ আয়াত অনুসারে আমরা যদি জীবন পরিচালনা করি, তাহলে আমাদের মাঝে আজ যে মতভেদ, পরস্পর বিভক্তি তা দূর হবে। আমাদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত থাকবে। জাতীয় ও ধর্মীয় ঐক্য সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে। এ ঐক্যই আমাদের এক উম্মতে পরিণত হওয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করবে, ফলে আমরা এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হতে পারব। এজন্য আমাদের আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে মহানবি (সা.)-এর পরিপূর্ণ অনুসরণ করা, তার শিক্ষানুসারে চলা।
ঐক্য সম্পর্কে রাব্বুল আলামিন কুরআনের অন্যত্র এরশাদ করেন, ‘তোমরা সেসব লোকের মতো হয়ো না, যাদের কাছে স্পষ্ট ও প্রকাশ্য নিদর্শন আসার পরও তারা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে এবং নানা ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে, তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি।’ (সূরা আল ইমরান : ১০৫)।
মহান আল্লাহ আরও বলেন, ‘আর ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারী একে-অপরের সহযোগী। তারা ভালো কথার শিক্ষা দেয় এবং মন্দ থেকে বিরত রাখে। সালাত প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অনুযায়ী জীবনযাপন করে। এদেরই ওপর আল্লাহতায়ালা দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশীল, সুকৌশলী’। (সূরা তাওবাহ : ৭১)।
হজরত হারেছ আশ ‘আরী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর নবি (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহতায়ালা ইয়াহ্ইয়া ইবনু যাকারিয়া (আ.)কে পাঁচটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন : (অতঃপর দীর্ঘ হাদিস উল্লেখ করেন)। তাতে রয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমি তোমাদের পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছি, আল্লাহ আমাকে যেগুলোর নির্দেশ দিয়েছেন-১. দলবদ্ধভাবে জীবনযাপন করা, (২) আমিরের নির্দেশ শ্রবণ করা, (৩) তার আনুগত্য করা, (৪) হিজরত করা ও (৫) আল্লাহর পথে জিহাদ করা। কেন না যে ব্যক্তি জামাত থেকে এক বিঘাত পরিমাণ বের হয়ে গেল, সে তার গর্দান থেকে ইসলামের গণ্ডি ছিন্ন করল যতক্ষণ না সে ফিরে আসে। আর যে ব্যক্তি মানুষকে জাহেলিয়াতের দিকে আহ্বান জানাল, সে জাহান্নামিদের দলভুক্ত হলো।
তখন এক লোক বলল, হে আল্লাহর রাসূল (সা.)! যদিও সে সালাত আদায় করে এবং সিয়াম পালন করে? তিনি বললেন, যদিও সে সালাত আদায় করে এবং সিয়াম পালন করে। অতএব, তোমরা আল্লাহর প্রদত্ত নামে ডাক। যিনি তোমাদের মুসলিমিন, মুমিনিন ও ইবাদুল্লাহ (আল্লাহর বান্দা) নামে নামকরণ করেছেন’। (তিরমিযী; আহমাদ; ছহিহুল জামে; জিলালুল জান্নাহ; ইবনু খুযায়মাহ; হাকেম; শু‘আবুল ঈমান; ছহিহ তারগিব; মুসনাদু ত্বায়ালেসি)।
রাসূলে আকরাম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জীবনযাপন কর, সংঘবদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনযাপন করো না, কারণ, বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করলে শয়তানের কুপ্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।’ (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)।
লেখক :মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
গবেষক ইসলামি চিন্তাবিদ
সূত্র: যুগান্তর